'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব, হর ঘর তিরঙ্গা’- এই উৎসবের অংশ তো সেই নাগরিকও, যে দেশের স্বাধীনতা দিবসের মাহেন্দ্রক্ষণে খিদের জ্বালা সহ্য করে ঘুমোতে যায়। তার ক্ষীণ কণ্ঠ আওয়াজ না তুললেও মনে মনে হয়তো বলে ওঠে- 'পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। উৎসব হয়তো তাকে স্পর্শ করে না, তার কণ্ঠস্বর শোনার মতো ধৈর্য কি আছে এই উৎসবমুখর দেশের?
উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়েছিল গত বছর ১৪ মার্চ। সবরমতী আশ্রম থেকে 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব'-এর সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই ঢাকের তালে তাল মিলিয়ে অঢেল আয়োজন কেন্দ্রের। দেশের আম-নাগরিকের মনে স্বাধীনতার ৭৫- এর পুণ্যলগ্নে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করার মধ্যে দোষ কোথায়? কিন্তু এই দেশেই তো আজও, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ফুটপাথে কত শিশু পেটে খিদের জ্বালা লুকিয়ে রেখে ঘুমোতে যায়! এখনও স্বাস্থ্য সংবিধানের মৌলিক অধিকার নয়! বেকারত্বর জ্বালা বুকে নিয়ে কত যুবকের স্বপ্ন ফানুসের মতো শূন্যে বিলীন হয়ে যায়! এর পরেও ইসরো মহাকাশে তিরঙ্গা ওড়ায়। দেশের 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' উদযাপনে নয়া উদ্যোগ ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো-র। স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে সবচেয়ে ছোট বাণিজ্যিক রকেট SSLV উৎক্ষেপণ করবে ইসরো। এই রকেটে ভর করে মহাকাশে উড়বে তিরঙ্গা। শুধু ইসরো নয়, কেন্দ্রের নির্দেশ মেনে দেশকে উপহার দিচ্ছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-ও। ভারতের যেসব সৌধ ও স্থাপত্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র মাধ্যমে দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, সেইসব স্থানে প্রবেশের জন্য দিতে হবে না কোনও টাকা। ৫ অগাস্ট থেকে ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ওই সৌধগুলিতে ঢোকা যাবে বলে জানানো হয়েছে কেন্দ্রের তরফে।
অন্যদিকে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে বেকারত্ব,
চড়া মূল্যবৃদ্ধির আবহে কাজের বাজার নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়ল। উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রবিবার (৭ অগাস্ট) শেষ হওয়া সপ্তাহে বেকারত্ব একলাফে পৌঁছেছে ৯.৬৬ শতাংশে। তার আগের সপ্তাহে তা ছিল ৬.৭৩ শতাংশ। শুধু গ্রামেই ওই হার ৫.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে পৌঁছেছে ১০ শতাংশের (৯.৮৮ শতাংশ) কাছে। শহরেও বেকারত্ব ৯ শতাংশের ওপরে। ৩১ জুলাই শেষ হওয়া সপ্তাহে এই হার ছিল ৮.৩১ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সুদ বৃদ্ধির জেরে শিল্পের মূলধন জোগাড় করার খরচ বেড়েছে।
সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছে। তারপরেও স্কুলছুটের প্রবণতা কমানো যায়নি। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করছে দেশ। কিন্তু দেশের অসংখ্য শিশু প্রাথমিক শিক্ষার মুখ দেখছে না। স্বাধীনতার এত বছর পর নিরক্ষরতায় আমাদের অগ্রণী অবস্থান কি লজ্জা দেয় না?
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অজর্নের সময় দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১২ শতাংশ। ২০১১ সালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৭৪.০৪ শতাংশ। ২০০৮ সালের জুন মাসে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা কার্যালয় (এনএসএসও) পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ৭ বছর পর্যন্ত সাক্ষরতার হার ৭২ শতাংশ। কিন্তু পূর্ণবয়স্কদের (১৫ বছর ও তার বেশি) সাক্ষরতার হার ৬৬ শতাংশ। সাক্ষরতার ক্ষেত্রে এই উন্নতি পাঁচগুণ হলেও ভারতে সাক্ষরতার হার বিশ্বের গড় সাক্ষরতার হার ৮৪ শতাংশর অনেকটাই নিচে। বর্তমানে নিরক্ষর জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বে প্রথম ভারত। একাধিক নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ সত্ত্বেও ভারতে সাক্ষরতা বৃদ্ধির হার শ্লথ। ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা গেছে, ভারতের ২০০১ থেকে ২০১১ দশকীয় সাক্ষরতা বৃদ্ধির হার ৯.২ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী দশকীয় হারের তুলনায় অনেক কম।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এই দেশ শিশুমৃত্যু আটকাতে পারেনি। পরিসংখ্যান বলছে, এ-ব্যাপারে ভারত বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপালেরও পিছনে। ইউনিসেফ প্রতি বছরই তাদের রিপোর্ট দ্য স্টেট অফ ওয়ার্ল্ড’স চিলড্রেন-এ পৃথিবীর সব দেশের ইনফ্যান্ট মর্টালিটি রেট বা শিশুমৃত্যুর হারের চিত্র তুলে ধরে। এরা যে ছবি তুলে ধরেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারত রয়েছে ১৩৯তম স্থানে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চিনের পিছনে। অর্থাৎ, প্রতিবেশী দেশের তুলনায় ভারত শিশুমৃত্যু রুখতে ব্যর্থ। বলছে পরিসংখ্যান।
সরকারি হাসপাতালের বেহাল দশা। অভিযোগ, ডাক্তাররা বেসরকারি হাসপাতালের দরজা দেখিয়ে দেন কখনও কখনও। দেশে কর্পোরেট হাসপাতালের রমরমা। স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর কেটে গেছে। দেশে কত আইন হয়েছে। কত আইন রদ হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মধ্যে ঠাঁই পায়নি স্বাস্থ্য। এদেশের টাকার অভাবে কত নাগরিককে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়। তাহলে এটাই কি বরাত লিখন?
স্বাস্থ্যের অধিকার আমাদের দেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মধ্যে নেই। নির্দেশক নীতিতে স্বাস্থ্যের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। একথা জানিয়ে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের পরামর্শদাতা পুণ্যব্রত গুণ একসময়ে বলেছিলেন, "আমরা দেখি যে, ১৯৪৮-এ ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস-এ স্বাস্থ্যের অধিকারের উল্লেখ ছিল। এরপর যখন সংবিধান রচিত হল, তখন সংবিধান প্রণেতারা স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দেননি। মানুষকে বেঁচে থাকতে গেলে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরিষেবাও প্রয়োজন।"
৩১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি 'মন কী বাত’ অনুষ্ঠানে `হর ঘর তিরঙ্গা’ কর্মসূচি নিয়ে কথা বলেন। তিনি সব দেশবাসীর কাছে আবেদন করেন, তাঁরা যেন সকলেই এই হর ঘর তিরঙ্গা অভিযানে শামিল হন। বাড়িতে, সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের প্রোফাইল পিকচারেও জাতীয় পতাকার ছবি লাগানোর অনুরোধ করেন। দেশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কি জানতে চাইবে, প্রদীপের নিচে এত অন্ধকার বলেই কি উৎসবে ভুলিয়ে রাখার এই তৎপরতা?
© & ® @Simanta Nandi