মৃত‍্যুহীন প্রান-ক্ষুদিরাম বোস

মৃত‍্যুহীন প্রাণ
================
কলমে :- সীমন্ত নন্দী
================

প্রথম পর্ব
******************
বোস" শব্দ টার মধ্যে একটা ঝংকার আছে,
একটা গরিমা আছে,একটি সাহসীকতার প্রতীক চিহ্ন আছে।"বোস" বাঙালি আর পাঁচটা নামের পরে নিজ ঠিকানা চিহ্ন একটা পদবী,সেই ছেলেটার ও ছিলো।তবে গড়ানো শান ইঁটের ভীত গড়ে সাদা চামড়ার বিদেশী শাসন যেভাবে চোখ রাঙিয়ে দাপিয়ে কাটিয়ে বেড়িয়েছিল,তাতে তাদের বুকে একটু  ভয় ধরানোর জন্য "বোস" শব্দ টা যথেষ্ট ছিল।যদি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ইংরেজ দের চোখের চশমা টেনে খুলে নেয়,তবে ক্ষুদিরাম বোস সেই চশমার কাঁচ টা ঘুসি মেরে অনেক আগেই ভেঙে দিয়েছিলেন।ব্রিটিশ শাসনের বসার চেয়ারের পাওয়া টা অনেক আগে ভেঙে দিয়েছিলেন মেদিনীপুরের ক্ষুদে বোস।বাংলার ইতিহাসে কিছু অংশ ক্ষুদে কে পাওয়া গেলেও ভারতের ইতিহাসে বা অন্য রাজ্যে এখনো ক্ষুদে অজ্ঞাত।কষ্টকর হলেও এমন ইতিহাস তবুও বলতে ইচ্ছে করে জোর কণ্ঠে।

     "নামের আকাশে ছোট্ট সে ক্ষুদে।
     আকাশে দেখো তাকিয়ে স্বাধীনতার বারুদে
     মুছতে না পারে ইতিহাস তুমি রইবে উচ্চপদে। 
     শত চেষ্টায় পারিবে না তোমাকে বিচ্ছেদে।"

হয়তো মিছে ইতিহাস আর দগ্ধ রাজনীতির চাপে ক্ষুদে কিছুটা বিলীন।কিন্তু জুঁই ফুলের সুগন্ধ যতই হাত চাপা দিক মুখে সে গন্ধ বিলিয়ে যাবে।তেমনি এক সাহসী যোদ্ধা ক্ষুদিরাম বোস।আসলে সেদিনের সেই বিদ্রোহী রণমূর্তি সেই ছেলেটার, তথাকথিত কিছু নাম ধারী মানুষের পছন্দ হয় নি সে রুপ।আসলে তারা চেয়েছিল প্রিয় মূর্তি সব ভক্তের কাছে প্রিয় হয়ে থাক,তাই সেদিনের ক্ষুদের স্মরণীয় কাজ কে ঘৃণা দিয়ে উপমা দিয়েছিল এক ব্যাক্তি।আবেগে ভারতবাসী ভাসার আগে জলের তাপমাত্রা শিথিল করে দিল।কিছু বলার আগে চুপ সেদিন কিছু অনুগামী।

            ১৯০৮ সালের এগারোই অগস্ট ভোর ছ’টা। মজঃফরপুর জেলে ফাঁসি হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসুর। ক্ষুদিরাম অর্থাৎ আজকাল পাঠ্যপুস্তকে যে সন্ত্রাসবাদী বলে পরিচিত। বছর চোদ্দোর ছেলে সুশীল সেনকে প্রকাশ্যে চাবুক মারার আদেশ দেওয়া অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে যে স্বহস্তে শাস্তি দিতে গিয়ে ভুল করে মিস ও মিসেস কেনেডিকে মেরেছিল। সেই ক্ষুদিরাম অনেকের কাছেই হতভাগ্য অপরিণত যুবক বলে বিশেষ মায়ামমতার অধিকারী। বলা বাহুল্য, এঁরা স্বঘোষিত মানবতাবাদী। এঁদের কাজই হল যে কোনো ঐতিহাসিক চরিত্রের কৃতিত্ব-মহিমা-শিক্ষা এগুলিকে একপাশে ঠেলে (Too mainstream?) “নির্মোহ নিরপেক্ষ” বিশ্লেষণের নামে তার চরিত্রের অন্য দিকগুলি নিয়ে কাটাছেঁড়া করা। ক্ষুদিরাম নিয়ে সামান্য কিছু পড়াশোনার পর, এ হেন ক্রিয়াকলাপের উদ্দেশ্য খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে, তাই আজ এই প্রসঙ্গের অবতারণা।

এঁদের বক্তব্য মূলতঃ দুই ধারার:

১) ক্ষুদিরাম বসু আদালতে বয়ান বদলে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছিল।

২) ক্ষুদিরাম নেতাদের হাতে ব্যবহৃত একটি অপরিণত মনের কিশোর মাত্র।

এজাতীয় আলোচনায় কিছুটা আশ্চর্যভাবেই মানবতাবাদীরা একমাত্র অভ্রান্ত তথ্যসূত্র হিসাবে খাড়া করেন একটিমাত্র বইকে।

হেমচন্দ্র কানুনগোর লেখা সেই বইটির নাম “বাংলায় বিপ্লব-প্রচেষ্টা” হলেও, নামভূমিকার স্থান তার মধ্যে খুবই অল্প। এ দেশের বর্তমান অবস্থা ও সনাতন ধর্ম নিয়ে একরাশ অযৌক্তিক অভিযোগ, নেতা ও কর্মীদের প্রতি প্রভূত বিদ্বেষ, রাজনৈতিক কার্যকলাপের সমালোচনার নামে অদ্ভুত পরস্পরবিরোধিতা – এই সবই তাঁর বইটিতে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং কিয়দংশে হাস্যকরভাবে স্থান পেয়েছে।

পাঠক, ভুল বুঝবেন না। হেম কানুনগো মহাশয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমার কাটাছেঁড়া করবার প্রবৃত্তি নেই; তাঁর মতামত তাঁর ব্যক্তিগত। কিন্তু ভগ্নোৎসাহ ও বীতশ্রদ্ধ এক ব্যক্তির লেখা এই বইটি প্রামাণ্য ইতিহাস প্রণয়নে কীভাবে একমাত্র যুক্তি হয়ে উঠতে পারে, এ আমার বোধের অগম্য। আর দশটা রেফারেন্স-বই যখন অধিকতর তথ্যে সহমত হয়, তখন এ হেন “টেক্সট” নির্বাচনের অভিসন্ধি নিয়ে কিছু অপ্রীতিকর প্রশ্ন উঠে আসে বই কি !

মূল অভিযোগ তথা রিইনটারপ্রিটেশনের প্রসঙ্গে আসি। “মানবতাবাদী”রা বলে থাকেন ধরা পড়ার পর ক্ষুদিরাম পরস্পরবিরোধী বয়ান দিয়েছিল, এবং তার এই চারিত্রিক বিচ্যুতি বিশেষ গবেষণার দাবি রাখে।

ঘটনাপরম্পরা এইরূপ:

১৯০৭ সালে যুগান্তর মামলার বিচারক কিংসফোর্ডের কঠোর দমনমূলক রায়দানের জন্য বিক্ষোভের বারুদ জমেই ছিল, আদালত চত্বরে বালক সুশীল সেনকে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করার আদেশ দেওয়ায় তাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ-সংযোজন ঘটে। এরপর বিপ্লবীদের আদালতে কিংসফোর্ডের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়, বই-বোমার আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী সেই মৃত্যুপরোয়ানা নিয়ে কিংসফোর্ডের নতুন চাকুরীক্ষেত্র মজঃফরপুরে উপস্থিত হয়। ৩০শে এপ্রিল ১৯০৮ – রাত সাড়ে আটটায় বোমা ছোঁড়ার পরে অকুস্থল থেকে দুই বিপ্লবী দুদিকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর পয়লা মে ওয়াইনি স্টেশনে দুই কনস্টেবলের হাতে ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে। তাকে প্রহরার মধ্যে নিয়ে আসা হয় মজঃফরপুর স্টেশন হয়ে ইওরোপীয়ান ক্লাবে। সে সম্পর্কে ইংরেজ সরকারের পক্ষপাতী স্টেটসম্যান (2.2.1908) জানাচ্ছে –

“HE CAME OUT OF A FIRST CLASS COMPARTMENT AND WALKED ALL THE WAY TO PHAETON, KEPT FOR HIM OUTSIDE, LIKE A CHEERFUL BOY WHO KNOWS NO ANXIETY…ON TAKING HIS SEAT THE BOY LOUDLY CRIED BANDEMATARAM.”

একটু দেখে নিই, “অপরিণত মানসিকতার” ছেলেটি এরপর এমন কী স্ববিরোধিতা করেছিল, যেকারণে  তাকে পরীক্ষামূলক সাহিত্যের বিষয়বস্তু করা (পড়ুন তার “বিচ্যুতি”কে হাইলাইট করা) উচিত।

১) ম্যাজিস্ট্রেট উডম্যানের কাছে ২রা মে ক্ষুদিরামের প্রথম বয়ান, বোমা সে-ই ছুঁড়েছিল। (৭ই মে এটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়) ততক্ষণে সে জেনে গেছে –“ম্যাজিস্ট্রেটকে মারতে গিয়ে মেরেছি নির্দোষী!”

২) ২৩শে মে আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট বার্থাউডের কাছে ক্ষুদিরামের দ্বিতীয় বয়ান, বোমা ছুঁড়েছিল দীনেশ রায়। (প্রফুল্ল চাকীকে যে নামে সে চিনত)

এই দুই বক্তব্যের ফাঁকে নবইতিহাসপ্রণেতারা মানবিকতার স্বার্থে তুলে নিয়ে আসেন ভীতু ক্ষুদিরামকে।

নব-ঐতিহাসিকরা যেটা মিস্ করে যান (স্বেচ্ছাচক্ষুবন্ধও হতে পারেন) তা হল পার্থক্য তো শুধু দুটি বয়ানের নয়, তাদের মধ্যে সময়টারও। এই সময়টার মধ্যে ক্ষুদিরাম জেনে গেছে ইতিমধ্যে ইনস্পেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জীর বিশ্বাসঘাতকতায় মোকামা স্টেশনে শহীদ হয়েছে প্রফুল্ল চাকী।

আদালতে পরবর্তী সওয়ালে প্রমাণ হবে, বোমা নিক্ষেপের মূল ভূমিকা তারই। প্রফুল্লর মৃত্যুসংবাদ পেয়েও ক্ষুদিরাম প্রথম বানানো বয়ানটা কেন পুনরাবৃত্তি করবে, প্রফুল্লকে তার প্রাপ্য কৃতিত্ব দেবে না, তার কোনো সঙ্গত কারণ দেখাতে পারেন?

পরের যুক্তিটা উঠে আসে, তার উচ্চতর আদালতে প্রাণদণ্ড রদের আপীল করার কথায়। পরপর দুটি ঘটনার সাহায্যে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়, বিপ্লব নামক পুরো প্রয়াসটাকেই সে হঠকারী মনে করতে শুরু করেছিল। অথবা হয়তো ─ এ অভিযোগ আরও সহজ ─ ধরা পড়ার পর একটা সাধারণ ভীতু ছেলের চিত্তবৈকল্য?

হে পাঠক, অবধান করুন।

কোনোরকম প্ররোচনা ছাড়া কেবল “ভয়”-এর বশে তার উচ্চ আদালতে আপীল করা কতদূর সঙ্গত? ক্ষুদিরাম মেদিনীপুরে আগেও আদালতে উঠেছে, তার আচরণে ঘাবড়ে যাওয়ার হদিশ মেলেনি। আর ঘটনার ধারাবাহিকতা বলে যদি কিছু থেকে থাকে, এই ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক হত্যাপ্রচেষ্টা, ধরা পড়ে সঙ্গীকে বাঁচিয়ে নিজের ঘাড়ে দোষ টেনে নেওয়া অকপট স্বীকারোক্তি, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শেষ ইচ্ছে হিসাবে বোমার চেহারা বর্ণনা করতে চাওয়ার নির্লিপ্ত ঔদ্ধত্য, এবং শেষ পর্যন্ত ফাঁসির মঞ্চের দিকে সেপাইদের টেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া – এই সমস্ত কাজের ফাঁকে প্রাণভয়ে দণ্ড রদ করার আবেদনটা কি বিসদৃশ লাগছে না একটুও ? বা “ভয়” পেয়ে আদালতে মিথ্যাভাষণ ?

বিভিন্ন বই ও নথি থেকে যে “গল্প”টা জানতে পারি, তা মোটামুটি এইরকম: ক্ষুদিরামের তরফের উকিল কালিদাস বসু তাকে নানাভাবে উপরোধ করেন, আপীলের জন্য দলিলে সই করতে। ক্ষুদিরাম অসম্মত হয়। তখন উকিলরা প্রধানত একখানা যুক্তি এবং আরেকটা সেন্টিমেন্ট তার কাছে পেশ করেন। প্রথমতঃ, তাঁরা আশা দেখান, কারাদণ্ড ভোগ করাকালীন যদি কোনোভাবে ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন সাফল্যলাভ করে, তবে স্বাধীন ভারতের নাগরিক হওয়ার স্বপ্নটা তার এ জন্মে সফল হয়ে যেতেই পারে! অথবা কোনোভাবে যদি জেলের বাইরে আসতে পারে, তা হলে ভবিষ্যতে আরও দেশের কাজ করতে পারার সম্ভাবনা আছে!

তাঁরা জানতেন, ছেলেটির দুর্বলতা কোথায়। আপীলে কোনো কাজ হবে না, ক্ষুদিরাম এই ধারণার কথা জানাতেই তার জন্য বিনামূল্যে প্রাণপাত করে লড়ে-যাওয়া উকিল তার কাছে পিতৃতুল্যের দাবি হাজির করেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, “তোমার বাবা থাকলে এভাবে মুখের ওপর না বলতে পারতে” এই মন্ত্রেই সেই চালচুলোহীন, তিনমুঠো খুদের বিনিময়ে কেনা ছেলেটা বশ মানে। অযাচিত ভালোবাসার উপরোধে পড়ে সইটা করেই দেয় সে।

কাজেই “ভয়” সে কোনদিনই পায়নি। যারা বিচ্ছিন্নভাবে এই দুটি ঘটনাকে খাড়া করে ক্ষুদিরামকে “ভীতু” প্রমাণ করতে চান, মানবতাবাদের সৌম্যদর্শন মুখোশের নীচে তাঁদের ভণ্ডামিটা বেশ স্পষ্ট চোখেই ধরা পড়ে।


দ্বিতীয় পর্ব
****************

 

এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসা যাক। আমরা বলি, বাড় খেয়ে ক্ষুদিরাম। (“আমরা বলি” বললাম, কারণ যাঁরা বলেন তাঁদের আমরা বাঙালি জাতি দিয়েছি প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী বা বিদগ্ধ সাহিত্যিকের মর্যাদা)। ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা কেউ বোধ করে না, এবং এ হেন লোভনীয় প্রবাদের অর্থ জানেন না বা কোনোদিন শোনেননি এমন বাঙালি কমই আছে। অদৃশ্য সুযোগসন্ধানী পক্ষের অঙ্গুলিহেলনে, ভ্রান্ত আদর্শে পরিচালিত ও ব্যবহৃত হওয়ার উদাহরণ হিসেবেই ক্ষুদিকে মনে রেখেছি আমরা। এ-ও সেই “জনবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসবাদী” ন্যারেটিভেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেন উচ্চতর বুদ্ধিজীবী মহলের গভীরতর “মানবিক” চিন্তাধারাই trickle down hypothesis মেনে এই উপমায় পরিণত হয়েছে।

চলুন দেখে নিই, ক্ষুদিরামকে যারা যারা বাড় খাইয়েছিল, তাদের পরিচিতি এবং ক্ষুদিরামের দ্বারা তারা কতটা লাভবান হয়েছিল।

১) মেদিনীপুরের সত্যেন্দ্রনাথ বসু। রাজনারায়ণ বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র, সম্পর্কে শ্রীঅরবিন্দের মামা, এবং ক্ষুদিরামের বিপ্লব-গুরু। গুরু-অর্থে মগজধোলাই করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা কোনো এনটিটি নন, খাঁটি ইস্পাতকে তিনি অস্ত্র হওয়ার দিশা দেখিয়েছিলেন মাত্র। ইতিহাস বলছে, নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড জেনেও এই মানুষটি ক্ষুদিরামের ফাঁসির মাসেই আলিপুর জেলের মধ্যে নরেন গোঁসাই হত্যায় স্বেচ্ছায় ও সুপরিকল্পিত ভাবে নিজেকে জড়ান, এবং চার মাসের মধ্যেই নিজেও ফাঁসি যান। এই অতিসংক্ষিপ্ত অথচ পূর্বনির্ধারিত সময়ে ক্ষুদিরামকে ব্যবহার করে সত্যেনের ব্যক্তিগত মুনাফার তথ্য আমার অজানা; কেউ সরবরাহ করলে কৃতজ্ঞ থাকব।

২) বারীন ঘোষ। বিপ্লবীর আদর্শচ্যুতির প্রথম জাজ্বল্যমান নিদর্শন তিনি। ধরা পড়ার পর অযথাই স্বীকারোক্তি করেছিলেন। অসংখ্য কর্মীর প্রতি পরোয়া না করা বারীন্দ্রকুমারের একের পর এক মারাত্মক ভ্রান্তিগুলির জন্য অগ্নিমূল্য ধরে দিতে হয়েছিল বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনকে। কিন্তু ক্ষুদিরামকে ওই অভিযানে পাঠানোর প্রধান এবং প্রকাশ্য উদ্দেশ্য ছাড়া ওই মুহূর্তে তাঁর আর কোনও ব্যক্তিগত লাভের আশা ছিল কি? স্বীকারোক্তিতে কিন্তু তিনি সজ্ঞানে নিজেরও ফাঁসি অথবা দ্বীপান্তর নিশ্চিত করিয়ে নিয়েছিলেন, অর্থাৎ ১৯০৮-এর প্রেক্ষাপটে অন্ততঃ তিনি চূড়ান্ত শাস্তি থেকে গা বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই করেননি!

৩) মামলায় অংশগ্রহণকারী আইনজীবীরা। ঘটনার পরেও তার রেশ থাকে ─ লাশের রাজনীতি শব্দটা আমাদের সকলেরই পরিচিত; তাই এঁদেরও টেনে আনতে হল। তবে নিজে হাতে মুক্তির পথরোধ করার পরও সেই ছেলেটার পাশে সেদিন যে আইনজ্ঞরা দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা কিন্তু কাঞ্চনমূল্যের প্রত্যাশা করেননি। বিনা স্বার্থে বিনা পারিশ্রমিকে রাজরোষের সামনে অকুতোভয় দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। আর ক্ষুদিরামের শেষযাত্রার বর্ণনা তো অতি সহজলভ্য। সেখানে জানা যায় যাঁরা ক্ষুদিরামের শবদেহ হিন্দুমতে দাহ করেছিলেন বা তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, (সেই অধুনা-অখ্যাত ব্যক্তিদের একজন একটি মর্মস্পর্শী আখ্যানও লিখে গেছেন, কিমাশ্চর্যম্) তাঁদের সঙ্গে ছেলেটির রক্তের সম্পর্ক বা আর্থিক লেনদেনের হিসাব কোনোটাই ছিল না। বাঁচবার প্রত্যাশা না করেই ক্ষুদিরাম একের-পর-এক বেপরোয়া কাজ করেছিল, তা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানোর চেষ্টা থেকে বিরত হননি তাঁরা, এমনকি মরবার পরও চিতা থেকে উড়ে আসা জ্বলন্ত ছাইটুকুর দহন সসম্মানে গ্রহণ করেছেন।

পারিপার্শ্বিক প্রমাণাদি থেকে পাঠক বাড় খাওয়ানো আর কোনো পক্ষকে খুঁজে বার করতে পারলে, অনুগ্রহ করে জানাবেন।

বাড় খেয়ে ক্ষুদিরাম প্রসঙ্গে আরেকটি মূল্যবান ঐতিহাসিক নথি রয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল

“NOWHERE IN THE DEFENCE DURING THE TRIAL WAS IT STATED THAT THE ACCUSED WAS A TOOL IN THE HANDS OF OTHERS. IN HIS CONFESSION HE CLAIMED THAT THE INTENTION TO COMMIT THE CRIME WAS HIS OWN, THOUGH IT HAD BEEN AROUSED BY THE SPEECHES AND WRITINGS OF OTHERS AND THAT THE COMMISSION OF THE CRIME WAS CARRIED OUT BY HIM AND DINESH AT THEIR OWN INITIATIVE.”

হ্যাঁ, ক্ষুদিরামের পক্ষের আইনজীবীরা যেনতেনপ্রকারেণ তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন। যে কোনো মূল্যে, এমনকি মানসিক অসুস্থতার অজুহাতেও ছেলেটির জীবনরক্ষাই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল; এবং কীভাবে বলে বুঝিয়ে এবং চাপ দিয়ে তাঁরা ক্ষুদিরামের থেকে আবেদনে স্বাক্ষর আদায় করেছিলেন সেটা আগের পর্বে লিখেছি। কিন্তু আদালত জানাচ্ছে, ক্ষুদিরামের দৃপ্ত স্বীকারোক্তির জন্যই সে অ্যাপীল নাকচ হয়ে যায়; বিচারক জানান “that the accused was a mere tool in the hands of others in committing the crime” এটি একেবারেই যুক্তিপূর্ণ নয়।

ব্যাপারটা আসলে হয়তো কিছু প্রিয় নায়কের গুরুত্ব খর্ব করার ইচ্ছে। বাঙালীর চেতনাগত আত্মঘাতী প্রচেষ্টাগুলি তো চিরকালই “সগৌরবে চলিতেছে”! ক্ষুদিরামের জাতি পরিণত হয়েছে অশিক্ষার গর্বে উদ্বাহু নৃত্য করা জনতায়, এবং যা আরও দুঃখজনক, সচেতন ভাবে ইতিহাসকে ধ্বংস করা মেকি পণ্ডিতে।

 

তৃতীয় পর্ব
***************

 

দণ্ডাদেশ শুনে সেদিন আঠেরোর কিশোর হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিল কাঠগড়ায়।

জজসাহেব শুধোলেন, আদেশের মানে বুঝেছ?

হাসিমুখে ছেলেটা বললে, আমি যে গীতা পড়েছি!

(“বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম। কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্।।” ২/২১)

ক্ষুদিরামকে যারা ভণ্ড নেতৃত্বের হাতের পুতুল, হঠকারী যুবক বলে প্রতিপন্ন করেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন – আদর্শ ছিল না কি ? শুধুই গোঁয়ার্তুমি ? বোধ ছিল না ক্ষুদিরামের ?

অগ্নিযুগের উন্মেষকালে দেশ স্বাধীন করার বাসনা নিয়ে যারা আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল, তাদের লক্ষ্য-আনুগত্য সবকিছু ছিল দেশের প্রতি একনিষ্ঠ। কর্মপদ্ধতি ও আদর্শ ছিল ভারতবর্ষের দর্শনে প্রোথিত। তাই পরবর্তী কোনো ভিন্নধারার ভুঁইফোড় আন্দোলনের ব্যর্থতাকে জাস্টিফাই করার জন্য ক্ষুদিরামকে ছোট করা ঠিক প্রবল শীতের প্রাণদায়ী আগুন আর সিগারেটের ডগার তুলনার মতই হাস্যকর। মিথ্যে স্বপ্নের মায়াজালে তরুণদের বলি করার দেশজ-শিকড়হীন আন্দোলনের সঙ্গে ক্ষুদিরামকে গুলিয়ে ফেলা হয় (নাকি ইচ্ছাকৃত/পরিকল্পিত ভাবে গুলিয়ে দেওয়া হয় ?), তাকে টেনে নামিয়ে বসানো হয় ব্যর্থ আবেগের ধ্বংসাত্মক কার্যাবলীর সঙ্গে একাসনে। তুলনামূলক চর্চা করার ক্ষেত্র এটা নয়, মৌলিক পার্থক্যগুলি চক্ষুষ্মান সুধীজনমাত্রই বুঝতে পারবেন। প্রশ্ন করবেন, সাহিত্যের ছলে বা মনস্তত্ত্ব অবলোকনের নামে মনগড়া গল্প রটানো অথবা স্থূলরুচির রসিকতার পিছনে উদ্দেশ্যটা কী ?

ক্ষুদিরাম ভয় পায়নি, ক্ষুদিরাম ব্যবহৃত হয়নি। তার স্বপ্নে যে কোথাও খাদ ছিল না তার সাক্ষী অবিকৃত ইতিহাস। তার উদ্দেশ্যে যে কোথাও দীনতা ছিল না, কর্তব্যে কোথাও হীনতা ছিল না, তার প্রমাণ শাসিত ও শাসক দুতরফের লিপিবদ্ধ নথি। এ প্রমিথিউস পবিত্র আগুন আনতে চেয়েছিল বিপ্লবের জন্য। সজ্ঞানে। স্বেচ্ছায়। নিজের বুকের পাঁজরে সেই বজ্রানল বহন করে এনেছিল কিশোর দধীচি।

ইচ্ছে হলে একে হিরো-ওয়রশিপ বলতেই পারেন। বীরপূজারী হওয়ার মধ্যে আমি কোনও অসম্মান দেখি না। তবে নয়কে হয় করে নয়, বিপক্ষের কথাগুলি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেই সিদ্ধান্তে আসছি। Deify করতে চাই না, শুধু vilify করার অক্লান্ত প্রচার দেখে কয়েকটা সত্যি কথাই বলতে চাইছি। ক্ষুদিরাম কোনও ভিক্টিম নয়, ভাগ্যহত পরাজিত নায়কও নয়। সে সমবেদনা নয়, সম্ভ্রমের দাবিদার।


চতুর্থ পর্ব
*****************


ফাঁসির মঞ্চে শেষ কথা কী বলেছিলেন শহিদ ক্ষুদিরাম, কী ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা ?

১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট, বয়স হয়েছিলো ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন। ফাঁসি হয়েছিল শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর। বাংলা তথা ভারত হারিয়েছিল এক আদন্ত নির্ভীক সন্তানকে। স্বাধীনতার স্বপ্নে যিনি মৃত‍্যুভয়কেও বশ করেছিলেন। এমনকী, ফাঁসির মঞ্চে তাঁর শেষ কথা চমকে দিয়েছিল উপস্থিত সকলকে।

প্রফুল্ল চাকি আত্যহত‍্যা করলেও ক্ষুদিরাম ধরা পড়েছিলেন ব্রিটিশদের হাতে। বিচারে তাঁর ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিচারক মি. কর্নডফ। রায় ঘোষণার পর ক্ষুদিরামের মুখে ছিল হাসি। অল্প বয়সী ক্ষুদিরামকে বিচারক কর্নডফ প্রশ্ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ফাঁসিতে যে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে তো ?

স্বাধীনতার আকাঙ্খায় এমনই নির্ভীক ছিলেন মেদিনীপুরের এই বিস্ময় যুবক। রায় ঘোষণার পর জীবনের শেষ কযেকটা দিনে কারাগারে বসে মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি ও রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়তে চেয়েছিলেন। ১০ আগস্ট আইনজীবী সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তীকে ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, 'রাজপুত নারীরা যেমন নির্ভয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়া জওহরব্রত পালন করিত, আমিও তেমন নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিব। আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খাইয়া বধ্যভূমিতে যাইতে চাই।'

আর ফাঁসির আগে ক্ষুদিরামের শেষ ইচ্ছা কী ছিল জানেন ? সেইসময়ও দেশের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করে গিয়েছেন তিনি। বলেছিলেন, তিনি বোমা বানাতে জানেন। ব্রিটিশদের অনুমতি পেলে সেই বিদ্যা ভারতের অন্যান্য যুবকদের শিখিয়ে যেতে ইচ্ছুক।

তবে ফাঁসির মঞ্চে এসেও যে প্রশান্তি ছিল তাঁর মনে, তা সবচেয়ে বিস্ময়কর। ১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট জেলের ভিতরে গড়া হয়েছিল ১৫ ফুট উঁচু এক ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে ছিল দুটি খুঁটি। তার উপর একটি মোটা লোহার রড ছিল আড়াআড়িভাবে লাগানো। সেই রডের মাঝখানে মোটা একগাছি দড়ি বাঁধা ছিল। তার শেষ প্রান্তে ছিল মরণ-ফাঁস।

ক্ষুদিরামকে সেই মঞ্চে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের চার পুলিশ। ক্ষুদিরাম ছিলেন তাঁদের সামনে। ফাঁসির আগে উপস্থিত আইনজীবীদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর পিছমোড়া করে বাঁধা হয় দুইহাত। গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্র জল্লাদকে শহীদ ক্ষুদিরাম প্রশ্ন করেছিলেন 'ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন ?' এটাই ছিল বীর শহিদের জীবনের শেষ কথা। জল্লাদ বিস্ময়ে কিছু বলতে পারেননি। বিস্ময়ে হতবাক হয়েগিয়েছিলেন ব্রিটিশ জেলার থেকে উপস্থিত সকলে। ফাঁসির আগে কী করে কারোর মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে ?
পলকের আড়ালে সেদিন ছোট্ট কিশোর জীবন দিয়েছিলেন।মহাত্মা গান্ধী ক্ষুদিরামকে সর্মথন করেন নি এবং উল্টে ইংরেজ দের বিরুদ্ধে হিংসাকে নিন্দা করেন।এবং ওই ইংরেজ মহিলার মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন করেন।

 তবুও মৃত্যুর ১১৩ বছর পরেও স্বাধীন ভারতের আপামর মানুষের মনে তিনি আজও অমর হয়ে বেঁচে থাকবেন।

ALL COPYRIGHT STRICTLY  ©

ALL RIGHTS RESERVED BY SIMANTA NANDI  ®
  Never miss a story from us, get weekly updates in your inbox.