মনোজ পান্ডে-কার্গিল যুদ্ধের একজন বীর সেনানী

একটা প্রবাদ রয়েছে, কলেজ জীবনে ডায়েরিতে একটা অন্তত কবিতা লেখেনি এরকম বাঙালি যুবক খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷ আসলে ওই সময়টা ওরকমই, প্রাণবন্ত, চাপমুক্ত, পাহাড়ি নদীর মতো খরস্রোতা। সৃষ্টির আদর্শ সময়ই বোধহয় ওটা। কিন্তু ধরুন আপনার ডান পাশে গুলির শব্দ, বাঁ-পাশে গ্রেনেড ফাটছে। এরকম মহাপ্রলয়ের মাঝে স্থিতধী শিবের মতো বসে থেকে কবিতা লিখতে পারতেন কি?

বাটালিক সেক্টরে তখন গ্রীষ্মকাল, অবশ্য লাদাখের এই অঞ্চলটাতে কী শীত আর কী গ্রীষ্ম! তাপমাত্রা সেই জমাট বেঁধেই আছে। বরফের উপর বসে রয়েছে এক বছর ২৪ এর যুবক৷ পরনে জলপাই রঙা পোশাক, কাঁধে বন্দুক, কিছুটা দূর থেকে গুলি গ্রেনেডের শব্দ এসে ধাক্কা দিচ্ছে কানে। ছেলেটির হাতে একটা ডায়েরি। খসখস করে কিছু একটা লিখছে সে, নিজের মায়ের উদ্দেশ্যে একটা ছোট কবিতা। আর তার নীচেই দু'টো লাইন...
'If death strikes before I prove my blood, I swear I will kill death.'
'দেশের হয়ে লড়াইয়ে নিজেকে প্রমাণ করার আগে মৃত্যু এলে, আমি মৃত্যুকে মেরে ফেলব।'

এমন লাইন যার কলম থেকে বেরোতে পারে সে ছেলে প্রেমিক না হয়ে যায় কোথায়? এ ছেলে প্রেমিক, আর এর প্রেমিকা ভারত...

১৯৯৫, বারানসি SSB-র ইন্টারভিউতে বসে রয়েছে এক ১৯ বছরের বাচ্চা ছেলে। সামনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বড় অফিসাররা। অফিসারদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন ছুটে এল,
- সেনাবাহিনী কেন জয়েন করতে চাও?
- পরমবীর চক্র পাওয়ার জন্য স্যার।
- পরমবীর চক্র কে কি খেলনা মনে করো?
- No sir, I will surely win it by my courage...

প্রশ্নকর্তা অফিসাররা বুঝেছিলেন এ জ্বলন্ত আগুন। NDA পাশ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন মনোজ, মনোজ পান্ডে। ১৯৯৯, কার্গিলে যুদ্ধ শুরু হয়েছে সীমান্তে। বাটালিক সেক্টরে ফাঁকা জুবার-টপ পোস্ট চুপিসারে দখল করে নিয়েছে পাকসেনা-জঙ্গির মিলিত শক্তি। গুরুত্বপূর্ণ এই পয়েন্টা পাকসেনার কাছ থেকে উদ্ধারের দায়িত্ব পড়ে ১/১১ গোর্খা রাইফেলসের উপর। জুলাই মাসের ১ তারিখ, মনোজ পান্ডের নেতৃত্বে জুবার টপের দিকে এগোতে থাকে গোর্খা রাইফেলস। কিন্তু সমস্যা হল পাক সেনা উঁচুতে পাথরের বাঙ্কারের আড়ালে, আর ভারতীয় সেনাবাহিনী নীচ থেকে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। ফলে পাক-সেনার গুলি ভারতীয় সেনাদের খুঁজে পেলেও উল্টো প্রায় হচ্ছে না! কিন্তু তাতে কী? এরকম অসম্ভব লক্ষ্য আর কঠিন শত্রুর উপর নেমে আসা ভয়ঙ্কর মৃত্যুর নাম-ই তো মনোজ পান্ডের ১/১১ গোর্খা রাইফেলস।

এর আগে, অপারেশন বিজয়ে মৃত্যুকে হারিয়ে জয় ছিনিয়ে এনেছে ক্যাপ্টেন মনোজের টিম। মনোজ পান্ডে সম্পর্কে ততদিনে একটা প্রবাদ প্রচলিত হয়ে গেছে সেনাবাহিনীতে,
' IF not Manoj, then who? '

২/৩ জুলাই, ১৯৯৯, রাত। উপর থেকে গুলি বৃষ্টি চলছে। খালুবারের দিকে একটু করে এগোচ্ছে মনোজ অ্যান্ড টিম। চাঁদের আলো শত্রুর সামনে উন্মুক্ত করে দিতে পারে তাদের। তাই চাঁদ মেঘে ঢাকা পড়লে এগোনো, আর চাঁদ বাইরে বেরিয়ে এলেই পাথরের আড়ালে চলে যাওয়া। অনেকটা উঠে এসেছিলেন মনোজরা। তবে শেষ রক্ষা হল না। পাক সেনার চোখে ধরা পড়ল ১/১১ গোর্খা রাইফেলসের জওয়ানদের গতিবিধি। শুরু হল গুলি, গ্রেনেড বর্ষণ। পাল্টা শুরু করলেন মনোজরাও৷ উপরে থাকা তিনটে শত্রুবাঙ্কারের প্রথমটা ধ্বংস করা গেল। টিমের একেবারে সামনে থাকা মনোজের ঘাড়ে ও পায়ে গুলি স্পর্শ করেছে ততক্ষণে। কিন্তু যে ছেলেটা পরমবীর চক্র পেতে আর্মিতে এসেছে ১৯ বছরে, তাকে কি আর এত অল্প আঘাত থামাতে পারে? বরং মনোজ তখন আহত বাঘ, পাক সেনার পরের বাঙ্কারটাও গুড়িয়ে দিলেন। এবার শুরু হল মনোজদের সঙ্গে পাক সেনার হাতাহাতি লড়াই৷

মাথা থেকে হেলমেট ভিজিয়ে রক্ত ঝরছে। মাথায় মেশিনগানের নল দিয়ে বারবার আঘাত করেছে পাকসেনা। কিন্তু ওই যে ছেলেটি লিখে এসেছিল,
'If death strikes before I prove my blood, I swear I will kill death.'
রক্তের প্রমাণ দেওয়ার আগে মৃত্যু এলে সেই মৃত্যুকেও মেরে ফেলবে সে। অতএব যম-ও কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে মনোজরূপী শিবের বিধ্বংসী তাণ্ডব নৃত্য দেখছে চুপচাপ। তার সাহস নেই মনোজের সামনে আসার...

খালুবারে স্বপ্নকে আলিঙ্গন করেছিলেন মনোজ পান্ডে। কয়েক মাস পর রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুত্রের মরণোত্তর পরমবীর চক্র নিয়েছিলেন মনোজ পান্ডের বাবা। যেখানে লেখা হয়েছিল, 'গুলি লাগার পরও একা হাতে চারজন শত্রু সৈন্যকে মেরে জুবার টপে ভারতের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট মনোজ পান্ডে। না শত্রুর গুলি, না মেশিনগানের খোঁচা, কিছুই থাকে থামাতে পারেনি খালুবার শত্রুমুক্ত করা থেকে...'

মনোজ পান্ডে, বিক্রম বাতরা, কণাদ ভট্টাচার্য, এরকম শতশত শহীদের রক্তে রাঙানো আজকের কার্গিল বিজয় দিবস৷ উৎসব করুন ভারতবাসী। আপনার আমার বাড়ি সুরক্ষিত কারণ সীমান্তে এখনও মনোজ পান্ডে, কণাদ ভট্টাচার্য, বিক্রম বাতরা-রা দাঁড়িয়ে আছে...


  Never miss a story from us, get weekly updates in your inbox.