এখন যেমন যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে টেলিফোন, মোবাইল ফোন, ই-মেল ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে তেমনি আজ থেকে বহু বছর আগে ‘টেলিগ্রাফ’ নামক যন্ত্র ব্যবহার করা হত যোগাযোগের জন্য। এই টেলিগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন বিখ্যাত মার্কিন উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানী স্যামুয়েল মোর্স (১৭৯১-১৮৭২)। এই টেলিগ্রাফ যন্ত্রটির দুটো অংশ থাকত-প্রেরক ও গ্রাহক। প্রেরক যন্ত্রের চাবি টিপে সংকেতধ্বনি দিলে সেটি বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় গ্রাহক যন্ত্রে ধরা পড়ত। এর সাথে যান্ত্রিক লেখনীর সাহায্যে কাগজের ফিতার উপর ডট ও ড্যাশ চিহ্ন(.-) আঁকা হয়ে যেত। আসলে, টেলিগ্রাফের সাংকেতিক চিহ্নই হল ডট ও ড্যাশ। টেলিগ্রাফের এই সাংকেতিক চিহ্নকেই বলা হত ‘মোর্স কোড’ বা ‘মোর্সের সংকেত’। এই সাংকেতিক চিহ্নগুলিকে বিভিন্নভাবে সাজালে যে অর্থ দাঁড়াত সেটি অক্ষরে লিখে ভাষায় রূপান্তরিত করা হত। এর ফলে বার্তা প্রেরণের কাজটি সম্পূর্ণ হত।
আমরা এই রচনায় এমন একজনকে নিয়ে আলোচনা করব যিনি বাংলায় মোর্স কোড পাঠিয়েছিলেন। এই মহান বাঙালি উদ্ভাবকের নাম রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য (১৮৮২-১লা আগস্ট, ১৯২৯)। বিজ্ঞানী মোর্সের মৃত্যুর দশ বছর পর অধুনা বাংলাদেশের শ্রীহট্টের বানিয়াচঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন রমেশচন্দ্র। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রমেশচন্দ্রের বিজ্ঞানসাধনা শুরু হয়েছিল। অনেক আগে থেকেই ‘মোর্স কোড’ ছিল তাঁর চর্চার বিষয়। রমেশচন্দ্র শ্রীহট্ট জাতীয় বিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষক থাকাকালীন নিজে থেকেই এমন এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন যার ফলে মোর্স কোডকে বাংলা হরফে লিখে তারবার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। ঘটনাটা এইরকম- ১৯১০ সালে শ্রীহট্টের জলসুখা জাতীয় সম্মেলন চলছে। এই সম্মেলনেই এমন সময় উঠে এলো রমেশচন্দ্রের পদ্ধতিতে বাংলায় প্রেরিত প্রথম তারবার্তা- “এখানে প্রচণ্ড প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ভয়ঙ্কর ঝড়ঝঞ্ঝার ভিতর দিয়ে সম্মেলন আরম্ভ হইয়াছে।” বলাবাহুল্য, ওই অধিবেশনে রমেশ্চন্দ্র প্রথম বাংলা অক্ষরে তারের বার্তা পাঠাবার গৌরব তো পেলেনই তার সাথে বাংলায় সফলভাবে বার্তা প্রেরণের জন্যে দুটি পদকও লাভ করেছিলেন।
রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য স্বদেশী আন্দোলনে বিশেষ অনুপ্রাণিত হয়ে নানান স্বদেশী দ্রব্য প্রস্তুত করেছিলেন।সেসব দ্রব্যের মধ্যে সাবান থেকে শুরু করে কাটা-ছেঁড়ার ওষুধ ‘সেরাম অয়েল’ সবই ছিল। এইসব দ্রব্য উৎপাদন ছাড়াও ভৌগোলিক মানচিত্র আঁকার কাজে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব ছিল। জীবনের পরবর্তীকালে তিনি শিলচর নর্মাল স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষকতা করেছিলেন। এছাড়াও, তিনি সহজ,সরল বাংলা ভাষায় বহু বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। আসলে, বিজ্ঞান তাঁর এতই প্রিয় ছিল যে বিজ্ঞান গবেষণা তিনি কোনোদিনও ছাড়েননি এমনকি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ-
বাঙালি চরিতাভিধান, সাহিত্য সংসদ
দেশ বিদেশের বিজ্ঞানী, অমরনাথ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স