রবীন্দ্রনাথের গানে মৃত‍্যুর দৃষ্টিকোন

আজ বাইশে শ্রাবণ। তাঁর মৃত্যু দিন। লক্ষ্য করা গেছে তাঁর গানে মৃত্যু চিন্তার ব্যাপ্তি কঠোর ভাবে সত্য। ছোট বেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ একটা সঙ্গীতের পরিমন্ডলে বড় হয়ে উঠেছিলেন। পিতা দেবেন্দ্রনাথের পরেই তাঁর দাদাদের প্রভাব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত জীবনে বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। তিনি নিজে তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে কৃতজ্ঞ চিত্তে বার বার স্মরণ করে বলেছিলেন,
“ জ্যোতিদাদা , যাকে আমি সকলের চেয়ে মানতুম, বাইরে থেকে তিনি আমাকে কোন বাঁধন পরাননি।আমার আপন মনের স্বাধীনতার দ্বারাই তিনি আমার চিত্ত বিকাশের সহায়তা করেছেন।”
যাই হোক যে বিষয়টা নিয়ে লিখব ভাবছিলাম ,
রবীন্দ্রনাথের গানে মৃত্যুর একটা অন্য রূপ জায়গা আছে। আত্মা অবিনশ্বর। তার মৃত্যু নেই। এই চিরন্তন বিশ্বাসকে রবীন্দ্রনাথ অনুধাবন করেছেন। রবীন্দ্র তাঁর গানে পরম বন্ধুর মতো মৃত্যুর স্বরূপকে উপলব্ধি করেছেন।
এই জগতে দুঃখ আছে। বিচ্ছেদ আছে। মৃত্যু আছে। রবি ঠাকুর মনে করতেন মৃত্যু নতুন জীবনের আগমনের বার্তাকে বহন করে।তাই রবি ঠাকুর বলেছেন,

“তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই-
কোথাও দুঃখ কোথাও মৃত্যু কোথা বিচ্ছেদ নাই॥"
জীবন মরণের সীমার বাইরে অসীমের মধ্যে তিনি তাঁর বন্ধু রূপী জীবনের দেবতাকে অনুভব করেছেন।
“ জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে
বন্ধু  হে আমার রয়েছে দাঁড়ায়ে!”
রবি ঠাকুর মৃত্যুর মাঝে দুঃখ থাকলেও তার মধ্যে একটা শান্তি , আনন্দের রূপও খুঁজে পেয়েছেন।
“আছে দুঃখ , আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জানে।”
রবি ঠাকুর তাঁর গানে মৃত্যুভয়কে জয় করতে শিখিয়েছেন। মৃত্যুর স্বরূপকে রবীন্দ্র নাথ নিজের মনে নির্ভয়ে গ্রহণ করেছেন।
“আমি ভয় করবো না , ভয় করবো না।
দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।”

".......যত বড়ো হও
তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও।
আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে        যাব আমি চলে।"

---------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রকাব্যে মৃত্যু এসেছে বিভিন্নভাবে। জীবদ্দশায় মৃত্যুকে তিনি জয় করেছেন বারবার। মৃত্যুবন্ধনা করেছেন তিনি এভাবে----- ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান। মেঘবরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট! রক্ত কমলকর, রক্ত-অধরপুট, তাপ বিমোচন করুণ কোর তব মৃত্যু-অমৃত করে দান ॥’

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলোতে কখনও তিনি শয্যাশায়ী, কখনও মন্দের ভাল। শেষের দিকে ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই, শান্তিনিকেতনের আশ্রম বালক-বালিকাদের ভোরের সঙ্গীত অর্ঘ্য তিনি গ্রহণ করেন তাঁর উদয়ন গৃহের পূবের জানলার কাছে বসে। উদয়নের প্রবেশদ্বার থেকে ছেলেমেয়েরা গেয়ে উঠেন কবিরই লেখা ----‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল আজ’।

রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্র জীবন কথা‘য় কবির মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন। তিনি লিখেন, শান্তিনিকেতনে কবি এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দেহ আর চলছিলনা, চিকিৎসার ও সেবারও ত্রুটি নেই। অবশেষে ডাক্তাররা পরামর্শ করে ঠিক করলেন, অপারেশন ছাড়া উপায় নেই।

৯ শ্রাবন (২৫ জুলাই) শান্তিনিকেতন থেকে কবিকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হলো। শান্তিনিকেতনের সাথে অনেক বছরের স্মৃতি জড়িত কবি কি বুঝতে পেরেছিলেন এই তার শেষ যাত্রা? যাবার সময় চোখে রুমাল দিচ্ছেন দেখা গেছে।

৩০ জুলাই, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবির শরীরে অস্ত্রোপাচার হল। তার কিছু পূর্বে শেষ কবিতা রচনা করেন---- ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি, বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী।’ চিকিৎসকরা অস্ত্রোপাচার করলেন তা নিস্ফল হয়। অবস্থা দ্রুত মন্দের দিকে যেতে লাগলো। তিনি জ্ঞান হারালেন। শেষ নিশ্বাস পড়ল - রাখীপূর্ণিমার  দিন মধ্যাহ্নে, বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২ শে  শ্রাবন, ইংরেজি ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তারিখ কবি চলে গেলেন অমৃতলোকে।

রবীন্দ্র ভক্তরা যেমন বাইশে শ্রাবণে অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রিয় কবিকে স্মরণ করেন, ভক্তি অর্চনা জানান- তেমনি কবির জীবনেও ছিল একটি বাইশে শ্রাবণ। সেই বাইশে শ্রাবণের অগ্নিকুন্ড জ্বালা নিয়ে কবিকে পার করতে হয়েছে বছরের পর বছর। তুষের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন কবি। কবির জীবনেও বাইশে শ্রাবণ একটি মৃত্যুর দিন। কবির সবচেয়ে প্রিয় দৌহিত্র নীতিন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ ছিল সেই বাইশে শ্রাবণের দিনে।

যদিও এ মৃত্যু প্রথম নয়। নিজের দীর্ঘমেয়াদী জীবদ্দশায় আঙিনা দিয়ে মৃত্যু শোকের দীর্ঘ মিছিল শুরু হয়েছিল। দৌহিত্র নীতিন্দ্রনাথের মৃত্যু ছিল মিছিলের শেষ বিন্দু। ইতিপূর্বে শোকের ঝড়ে উৎসবের প্রদীপ নিভে গেছে বারে বারে। আগেই দুই মেয়ে বেলা এবং রেনু অকালে মারা গিয়েছিলেন। আর মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মৃত্যু ঘটে তার মায়ের। মা সারদা দেবী ছিলেন নিষ্ঠাবতী বৈষ্ণবী, ধর্মমতী। সাত বছর বয়সে সাত পাঁকে বাঁধা পড়েন। দেবেন্দ্রনাথের তখন সতেরো। অল্পবয়সেই প্রথম সন্তানের জননী। তারপর একে একে পনেরটি সন্তানের গর্ভধারিণী।

জীবন স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ মায়ের সম্পর্কে লিখেছেন, ---‘যে রাত্রীতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতে ছিলাম। তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল- ‘ওরে তোদের কী সর্বনাশ হলরে’- স্তিমিত প্রদীপে অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল। কিন্তু কী হইয়াছে ভাল করিয়া বুঝিতে পারিলাম না। প্রভাতে বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপর শয়ান।’

রবীন্দ্রনাথের বিয়ের দিনেও মৃত্যু হানা দিতে ভুল করেনি। ঠাকুর পরিবারের বিয়ের নিয়ম ছিলো একটু অন্য ধরনের। পালকি চড়ে পাত্রীকেই আসতে হতো পাত্রের বাড়ীতে। সেই বিয়ের দিনেই ঘটে এক অলুক্ষুণে অঘটন। রবীন্দ্রনাথের দিদি সৌদামিনীর স্বামী সারদা প্রসাদ ছিলেন ঘরজামাই। ছোট ভাইয়ের বিয়ের দিনেই কপালের সিদুঁর আর হাতের শাঁখা দুটি হারালেন সৌদামিনী। আর তখনো পালকিতে বসে সলজ্জা সালঙ্কারা মৃণালিনী দেবী।

না মৃত্যু এখানে এসে থেমে থাকেনি। এবার আর এক ট্রাজেডি। বিয়ের পর চার মাস অতিক্রান্ত হতে না হতেই তার নতুন বৌঠান, জ্যোতিরিন্দ্র নাথের রূপবতী স্ত্রী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন।

কিন্তু আবারো কবি পরিবারে মৃত্যুর হাতছানি। মৃত্যু এসে আর একজনের শিয়রে দাঁড়ায়। মাত্র আঠাশ বছর বয়সে কবি স্ত্রীরও মৃত্যু হয়। তার আগে প্রথম সন্তান বেলার জন্ম হয় ১৮৮৮ সালে। তারপর সেজো মেয়ে রেনু এবং ছোট মেয়ে মীরা। এতোদিনে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর বিষয় হজম করে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেছেন। ১৯০১ সালে বড় মেয়ে বেলার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই বেলার মৃত্যু হয়। এবার মৃত্যু এসে ডাক দিয়ে যায় সেজো মেয়ে রেনুর জীবনেও।

হারাধনের দশটি ছেলের মতো রবীন্দ্রনাথের হাতেও থাকে আর একটি মাত্র মেয়ে মীরা। মীরার বর নগেন্দ্রনাথ ছিলেন ঠাকুরবাড়ীর ঘরজামাই। এই ঘরে বংশ প্রদীপ জ্বেলে রেখেছিলো একমাত্র পুত্র নীতিন্দ্রনাথ। তার বয়স যখন সবেমাত্র কুড়ি, অস্ফূট জীবনের কুঁড়ি যখন বিকশিত হবে রবীন্দ্রনাথ তাকে পাঠান বিলাতে। উন্নত ধরনের ছাপার কাজ ও প্রকাশন শিল্পের জ্ঞান অর্জন করে দেশে ফিরবে নীতিন্দ্রনাথ। এই প্রত্যাশ্যাই ছিলো কবির।

কিন্তু নিয়তির আর এক পরিহাস। বিলেতেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন নীতিন্দ্রনাথ। ২১ শ্রাবণ- ৬ আগস্ট মৃত্যুর সমন পৌঁছে যায় নীতিন্দ্রনাথের শিয়রে। ডাক্তারদের নাগালের বাইরে চলে যেতে থাকেন তিনি। পরদিন বাইশে শ্রাবণ ১৩৩৯ ইংরেজি ৭ আগস্ট ১৯৩২ মৃত্যই জিতে যায়। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নীতিন্দ্রনাথ। আর প্রিয় দৌহিত্রের মৃত্যুদিবস বাইশে শ্রাবণকে ধারণ করে কবিও বিদায় নেন আর এক বাইশে শ্রাবণে।

জীবনকে যেভাবে ভালবেসেছেন তিনি তেমনি ভালোবেসেছেন মৃত্যুকেও। তাইতো তার মৃত্যু ভাবনায় তিনি বলে গেছেন, মৃত্যু মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় নিমর্ম সত্য, নিশ্চিত ঘটনা তাই একে সবার ভালোবাসা উচিৎ। তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ------‘তোমার আঁখির আলো, তোমার পরশ নাহি আর
কিন্তু কী পরশমনি রেখে গেছ অন্তরে আমার’
..…সঙ্গীহীন এ জীবন শূণ্যঘরে হয়েছে শ্রীহীন, সব জানি, সবচেয়ে মানি,”  তুমি ছিলে একদিন”। এমন অসংখ্য গান কবিতায় রবীন্দ্রনাথ জগতকে সম্পূর্ণ ও সুন্দর করে দেখার জন্য মানুষকে মুত্যুকে উপলবদ্ধি করতে বলেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা সুন্দর উক্তির মাধ্যমে আমার এই শ্রদ্ধার্ঘ শেষ করব।( বর্ষশেষে শান্তিনিকেতনে) রবি ঠাকুর বলেছিলেন,
“মৃত্যু বড়ো মধুর। মৃত্যুই জীবনকে মধুময় করে রেখেছে। জীবন বড় কঠিন; সে সবই চায়, সবই আঁকড়ে ধরে ; তার ব্রজমুষ্টি কৃপণের মতো কিছুই ছাড়তে চায় না। মৃত্যুই তার কঠিনতাকে রসময় করেছে, তার আকর্ষণকে আলগা করেছে; মৃত্যুই তার নীরস চোখে জল এনে দেয়, তার পাষাণ স্থিতিকে বিচলিত করে।”


ALL COPYRIGHT STRICTLY  ©

ALL RIGHTS RESERVED BY SIMANTA NANDI  ®

  Never miss a story from us, get weekly updates in your inbox.