১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ আমেরিকা শিকাগো ধর্ম সভায় হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দের ভাষণের মধ্যেই সহিষ্ণু ভারতবর্ষের এক সুন্দর চিত্র তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন। তিনি ভাষণে বলেন," যে ধর্ম জগতকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতার ও সর্বাধিক মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়ে আসছে, আমি সেই ধর্ম ভক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকেই সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি। যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভাষায় ইংরেজি 'এক্সক্লুশন' (ভাবার্থ: পরিবর্জন) শব্দটি অনুবাদ করা যায় না, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলে গর্ব অনুভব করি। যে জাতি পৃথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়ে আসছে,আমি সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে নিজেকে গর্বিত মনে করি।" অতএব বোঝা যাচ্ছে ভারতবর্ষ কতটা সহিষ্ণু দেশ। ভারত সকল সম্প্রদায়, ভাষাভাষী মানুষদের নিজের করে নিয়েছে তার সংস্কৃতি, দর্শন ও হিন্দু ধর্মের উদারতার মাধ্যমে। ভারতবর্ষ কখনোই কোন সম্প্রদায়ের ওপর কোন কিছু বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়নি বা জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেনি। ভারতবর্ষের এই মহানুভবতার কারণে শত বিদেশি আক্রমণ সত্ত্বেও তার ধর্ম, সংস্কৃতি, দর্শন, ভাষা নিয়ে আজও পৃথিবীর বুকে স্বতন্ত্রভাবে সগর্বে টিকে আছে। ইতিহাস সাক্ষী আছে অনেক দেশ তাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা প্রভৃতি বিষয়কে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। কিন্তু ভারতবর্ষ তার ব্যতিক্রম কারণ, ভারতের অতি উচ্চমানের মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিকতাই ভারতকে এখনো স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষার্থে সাহায্য করে। স্বামীজি বলেছিলেন,' ভারতের মেরুদন্ড হল আধ্যাত্মিকতা'। এই ভারতবর্ষই অত্যাচারিত ইহুদি, পার্সি প্রভৃতি সম্প্রদায়কে নিজের দেশে আশ্রয় দিয়েছে; যা বিশ্ববাসীকে অভিভূত করে। এর মূলে আছে ভারতবর্ষের ধর্মের বহুত্ববাদের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি। ' *একং সৎ বিপ্রা বহুধা বদন্তি*' অর্থাৎ সত্য এক, জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাকে নানাভাবে বর্ণনা করেন। ভারতবর্ষে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। তাদের মধ্যে আস্তিকও ছিল আবার আজবিক, চার্বাকের মতো ভোগবাদী নাস্তিকও ছিল। প্রত্যেককেই সমানভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অন্য দেশে বিভিন্ন সময় জাতিগত কারণে, ধর্মগত কারণে, মতবাদগত কারণে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার জন্য। যার জন্য বলি হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। কিন্তু ভারতে এরকম ঘটনা প্রাচীনকাল থেকে ঘটেনি। বহুত্ববাদ ভারতের মজ্জায় মজ্জায়, যা হিন্দু ধর্মের প্রধান অঙ্গ। কিন্তু যখনই বৈদেশিক মতবাদ, বিদেশী শক্তি ভারতীয় মতবাদের উপর সেগুলি বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা শুরু করল সেই সময় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দেখা দিল। আমরা জানি এর ফলস্বরূপ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হল এবং তার পরবর্তী কালে বহু রক্ত ঝরল। কিন্তু বিদেশী শক্তির আক্রমণ এবং বিদেশি মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার কুটিল ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ভারতবর্ষ এই উত্তর আধুনিক কালেও তার সনাতন সহিষ্ণুতার আদর্শকে পাথেয় করে সমস্যাদীর্ণ বিশ্বকে পথ দেখানোর সুমহান লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে।